প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি গলাচিপার দুই তরুনীকে

প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি গলাচিপার দুই তরুনীকে
প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি গলাচিপার দুই তরুনীকে

নিয়ামুর রশিদ শিহাব,গলাচিপা(পটুয়াখালী) সংবাদদাতা
আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি থাকলে দমাতে পারে না কোনো প্রতিবন্ধকতা। শত বাধা বিপত্তীর পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া যায় স্বপ্ন পূরণের পথে। এমনি দৃষ্টান্ত স্থাপণ করে চলেছে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার দুই তরুনী। তারা হলেনঃ পৌরসভার বাসিন্দা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রতিবন্ধি ফাল্গুনী সাহা ও কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণকলস গ্রামের মেয়ে খারিজ্জমা কলেজের ২০১৯ এর এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমা আক্তার।


জানা গেছে, গলাচিপা পৌরসভার বটতলা এলাকার জগদীশ চন্দ্র সাহা ও ভারতী রানী দম্পতির সন্তান প্রতিবন্ধী ফাল্গুনী। চার ভাই বোনের মধ্যে ফাল্গুনী তৃতীয়। জন্মটা ছিল অন্য সকল পরিপূর্ণ শিশুর মত। বাবার সবচেয়ে আদরেরর সন্তান ফাল্গুনীর দুই চোখ ভরা ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল এক দুর্ঘটনা। ২০০২ সাল যখন ফাল্গুনীর বয়স মাত্র দুই বছর। একদিন ফাল্গুনী তার বোনের সাথে কাপড় শুকাতে পাশের বাড়ির ছাদে যায়। দুরন্ত শিশু সুলভ আচরণে ফাল্গুনী খেলা করতে থাকে ছাদে। এক পর্যায়ে ছাদের কার্নিস ঘেষে দাঁড়াতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী বিদ্যুৎ লাইনের সাথে তার দুটি হাত জড়িয়ে যায়। আর্তচিৎকারে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বিদ্যুৎ তারে জড়ানো অবস্থা থেকে উদ্বার করা হয় ছোট্ট ফাল্গুনীকে।এ সময় তার দু’হাতের কব্জি মারাত্মকভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়। পুড়ে যাওয়া দুটি হাত নিয়ে তাকে প্রথমে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার দিন থাকাকালীন ডাক্তারদের চরম অবহেলার কারণে তার দুটি হাতের ক্ষততে পচন ধরে যায়। অসহ্য যন্ত্রনায় ১১দিনও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার সঞ্চয় কিছু টাকা নিয়ে রওনা হয় ভারতের উদ্দেশ্য। তবুও শেষ পর্যন্ত রাখা যায়নি হাত দুইটো। পচন ধরে যাওয়ায় কব্জিসহ কেটে ফেলা হয় দুই হাত। সে চিরদিনের মত হয়ে যায় প্রতিবন্ধী। তবুও তার আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে যায় পড়ালেখা। ফাল্গুনীর প্রবল ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মানে পঙ্গুত্ব। ২০০৫ সালে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে এবং এসএসসি গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়াশনা করছে। ভবিষ্যৎ জীবনে পড়ালেখা শেষ করে বৃদ্ধা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হতে চান একজন বিসিএস কর্মকর্তা। এ জন্য সে সকলের সাহায্য ও দোয়া কামনা করেছেন।

অন্যদিকে গলাচিপা উপজেলার কলগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণকলস গ্রামের মো. ইউসুফ হাওলাদার ও মাজেদা বেগমের তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে লিমা সবার ছোট। জন্ম থেকেই লিমার পা দুটো উল্টোভাবে ভাঁজ হয়ে আছে। তাই সে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না। মা ও মেজ বোন সাবিনা তার প্রাত্যহিক কাজের সঙ্গী। পড়াশোনা করতে পারার পেছনে পরিবারের মানুষগুলো, শিক্ষক ও বন্ধুদের অবদানও কোনো অংশে কম নয় বলে জানান লিমা। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। তবুও নিজের প্রবল ইচ্ছায় ও একই গ্রামের অজয় স্যারের সহযোগিতায় লিমা ভর্তি হয়েছিল বাঁশবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইভেট পড়া ছাড়াই ২০১৭ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৩.৬৪ পেয়েছে। চলমান এইচএসসি পরীক্ষা খারিজ্জমা ডিগ্রি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ পরীক্ষা দিচ্ছে লিমা। এবার আরো ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশা লিমার। এত দূর পথ পাড়ি দেয়ার পথে ছিল নানা বিঘœ-বিপত্তী। দুই হাঁটুতে ভর করে বাড়ি থেকে ২কি.মি. পথ হেটে এক বিরাট সাঁকো পার হয়ে প্রতিদিন যেতো কলেজে। ছিল না কোনো হুইল চেয়ার কেনার সামর্থ্য। তবুও সে সব বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে আলোর পথে। এক সময় লিমার ব্যাপারটি নজরে আসে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের। তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর এগিয়ে আসে অনেকেই। গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জ মো.আখতার মোর্শেদ লিমাকে একটি হুইল চেয়ার প্রদান করেন। উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম ফরম পূরণের টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকেও পেয়েছে নানা ধরনের সহায়তা। এজন্য লিমা সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। এখন তার স্বপ্ন আরো সামনে এগিয়ে যাওয়া। তাই তিনি সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
এভাবেই সকলে এগিয়ে আসলে প্রতিবন্ধীরাও পারে তাদের ভিতর লুকানো স্বপ্ন ও প্রতিভা বাস্তবে রূপ দিতে। তাই সমাজের বিত্তবান লোকরা এগিয়ে আসলে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব।