“পড়ালেহা কইরা শিক্ষক হমু”

“পড়ালেহা কইরা শিক্ষক হমু”
“পড়ালেহা কইরা শিক্ষক হমু”


নিয়ামুর রশিদ শিহাব, গলাচিপা(পটুয়াখালী) সংবাদদাতা:
“সবার জন্য শিক্ষা” এ স্লোগানকে ধারণ করে কয়েকজন তরুনদের স্ব-উদ্দোগ্যে দরিদ্র শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত “স্বপ্ন পূরণ বিদ্যানিকেতন”। গলাচিপা পৌর এলাকার ১নং ওয়ার্ডের পুরান লঞ্চঘাটের পাশের বটতলার নিচে বিদ্যালয়টির অবস্থান।  
জানা গেছে, গরীব ঘরের শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতেই এই ব্যতিক্রমী উদ্দ্যোগ। দিনমজুর পরিবারের সন্তান বা জেলে সম্প্রাদায়ে শিশু যাদের নিজেদের অন্ন নিজেদের সংগ্রহ করা লাগতো সেসব গরীব শিশুদের বিদ্যালয়মূখী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে বরিশাল বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র ও গলাচিপা ছাত্র কল্যান পরিষদেরর সভাপতি সাকিব হাসান এবং স্থানীয় বেসরকারি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রুবায়েত হাসান রাসেল স্যার এর উদ্দোগ্যে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঝরে পড়া দরিদ্র ২৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় স্বপ্ন পূরণের কার্যক্রম। উদ্দোগ্যতা সাকিব হাসানসহ গলাচিপা সরকারি ডিগ্রি কলেজের ৪ শিক্ষার্থী তৌকিক রাইয়ান সাকিব, তানভির হোসাইন রিফাত, অমিত হাসান অকিব, জিতু আহমেদ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কলেজ পড়–য়া এসব শিক্ষার্থী পালাক্রমে সপ্তাহে ছয় দিন বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিদ্যালয়টির কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিনা পয়সায় বই-খাতাসহ চিকিৎসা সক্রান্ত বিভিন্ন সুবিধাও প্রদান করা হয়ে থাকে। লেখাপড়া ও বিদ্যালয় নিয়মিত উপস্থিত নিশ্চিত করতে তাদের প্রতিদিন চকলেট, বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য সরবারহ করে উৎসাহিত করা হয়। এক ঝাঁক তরুনদের মহতি উদ্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও সহযোগিতা করছেন গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. রফিকুল ইসলাম, গলাচিপা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফোরকান কবির, গলাচিপা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল হালিম, সিনিয়র সাংবাদিক শংকর লাল দাশ, সমাজকর্মী সর্দার মু. শাহ আলমসহ বিভিন্ন গুণী লোক। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই সাহায্য করছে। তারা মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটান ও চকলেট কিনে দেন। বিদ্যালয় সম্পর্কে অধ্যক্ষ মো. ফোরকান কবির বলেন, স্কুলটি আমি প্রায়ই পরিদর্শন যাই। ছাত্ররা যে উদ্যোগটি নিয়েছে এর প্রশংসা করি। আমরা সবাই এগিয়ে এলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিটি এলাকায় ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা কমে আসবে।
বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে বটগাছে নিচে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কখনো সরব পাঠ আবার কখনো লেখালেখিতে ব্যস্ত শিশুরা। রাস্তার পাশে হওয়ায় কৌতূহল নিয়ে বিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাঠ দেখছেন অভিভাবক ও পথচারীরা। বিদ্যালয়ের গরীব শিক্ষার্থীরা যাদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না তারা এখন পড়াশোনা করে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ অফিসার আবার কেউ ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পড়ার ফাঁকে চলে খেলাধুলা, গান, আবৃত্তি ও অভিনয়। আর এসবের পরে ছুটির সময় বিস্কুট বা চকলেট পেয়ে উল্লাস করে বাড়ি ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা।
ঘরে মায়ের সঙ্গে গৃহস্থালি কাজ করায় বিদ্যালয় যেতে পারেনি খাদিজা। খাদিজার মতো অনেক শিশুই আছে যাদের ইচ্ছা থাকলেও স্কুলে যেতে পারছে না। খাদিজা জানান, ‘আমি অনেক দিন ধইরা ইশকুলে যাই না। আমার মায়ের সাথে কাম করি। তয় এখন বিকেলে স্বপ্ন পূরণ স্কুলে যাই। আমার স্বপ্ন পড়ালেহা কইরা শিক্ষক হমু।’
ছাত্র নাজমুল হাসান বলল, ‘আমার বন্ধু জিসান ও হেনাকে ইশকুলে যাইতে দেইখ্যা আমারও ইশকুলে যাইতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কী করমু? যাইতে পারি না। আমারে পৌরসভার পূর্ব বাজারের একটি মুদি দোকানে কামে রাখছে। বেইন্নাকালে দোকানে যাই, রাইত ১০টার দিকে বাসায় আই। বেইন্নাকালে (ভোরবেলায়) আমার দোকানের সামনে দিয়া অনেক পোলাপানে ইশকুলে যায়। আমার যাইতে ইচ্ছা করত। একলা একলা অনেক কানছি। কয়েক দিন আগে মায়রে কইছি, আমি লেহাপড়া করমু। এহন কাজের ফাঁকে স্বপ্ন পূরণ ইশকুলে যাই ও পড়ালেহা করি।’
কাঁচামাল ব্যবসায়ী মমতাজ বেগম বলেন, ‘আগে আমরা লেহাপড়ার মর্ম বুঝি নাই। এহন বুঝি লেহাপড়া না অইলে কিছুই করা যায় না। এই ইশকুলে যাওয়ার পর দেহি আমাগো গুরাগারা ভালোই পড়ালেহা করছে। নিজেগো নাম লেখতে পারে।’
বিদ্যালয়টির পাশেই জান্নাতির মা সুুখি বেগমের চায়ের দোকান। জান্নাতি সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও হঠাৎ করেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেয়। পরে আবার স্বপ্ন পূরণ বিদ্যানিকেতনে যাওয়া শুরু করেছে। সুখি বেগম  বলেন, ‘কী করমু কন? আমার স্বামী গত এক বছরেরও বেশি সময় ধইরা আমাগো কোনো খবর নেয় না। হুনছি হে নাকি আরেকটা বিয়া কইরা পাট্টা (পাটুয়া) নদীতে নৌকায় আছে। জান্নাতিরে প্রথমে সরকারি ইশকুলে ভর্তি করছিলাম। সমস্যার কারণে যাইতে পারে নাই। এহন এইহানে বিয়ালে ইশকুলে যায়।
স্বপ্ন পূরণ বিদ্যানিকেতনের অন্যতম সদস্য অমিত হাসান অকিব বলেন, ‘আমরা ঝরে পড়া শিশুদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছি। আমাদের চোখে ওরা স্বপ্ন দেখবে।’
আরেক শিক্ষক তানভির হোসাইন রিফাত বলেন, ‘আমরা তখনই নিজেদের শিক্ষিত জাতি বলব যখন আমাদের চার পাশের সবাই শিক্ষিত হবে। ঝরে পড়া কোমলমতি শিশুদের আমরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছি।
উদ্দ্যোক্তা সাকিব হাসান জানান, জেলে সম্প্রদায়ের সন্তানদের দেখতাম তারা বাবা-মা এর সাথে মাছ ধরছে। এরা ভর্তি হলেও বিদ্যালয় যায় না। তাদের বিদ্যালয়মূখী করতে আমাদের এ উদ্দ্যোগ। এভাবে সকল তরুণদের চেষ্টা ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতায় অবহেলিত এই শিশুদের স্বপ্ন পূরণ হবে। এরকম প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষতার অভিশাপ দূর করা সম্ভব।